বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতির মধ্যেও দেশে এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। অথচ চালের বাজারে বইছে না সুবাতাস। উল্টো এমন দিনেও পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বেড়েছে প্রায় সব ধরনের চালের দাম। গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর খুচরা বাজারে চালের দাম প্রতি কেজিতে অন্তত দুই থেকে চার টাকা বেড়ে গেছে। মহামারীর মধ্যে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকার অপরিহার্য পণ্যটির দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন নিম্নআয়েরসহ সব শ্রেণির ক্রেতা। অন্যদিকে দাম বাড়ার বিষয়ে একপক্ষ আরেকপক্ষকে দুষছেন খুচরা, পাইকারি ও চালকল মালিকরা।
মহামারীর মধ্যে সরকারকে চুক্তিমূল্যে বোরো মৌসুমের চাল সরবরাহ না করে সেখানেও চালের দাম বাড়ানোর দাবি তুলেছেন চালকল মালিকরা। এতে চালকল মালিকদের ওপর চটেছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার। সরকারিভাবে সংগ্রহের জন্য চালের দাম বাড়ানো হবে না বলে জানিয়ে চাল সরবরাহে গড়িমসি করা মিল মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
চলতি বোরো মৌসুমে ২৬ টাকা কেজি দরে মোট ১০ লাখ টন ধান কিনবে সরকার। গতবারও একই দাম ছিল। তবে সংগ্রহের লক্ষ্য আরও দুই লাখ টন বেশি ছিল। সে হিসাবে বাম্পার ফলন আমলে নিলে ধানের সরবরাহ ঘাটতি বা দাম বাড়ার দৃশ্যত কোনো কারণ নেই। এর পরও
‘ধানের দাম চড়া’- কারণ দেখিয়ে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে চালকলগুলো। যার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারগুলোতে।
রাজধানীর চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, মে মাসের প্রথম দিকে দাম কিছুটা কম থাকলেও মাসখানেক সময় ধরে দাম বাড়তি রয়েছে। এ সময় চালকল মালিকরা বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা করে বাড়িয়ে দিয়েছেন। বেশি দামে কিনতে হয় বলে খুচরা পর্যায়েও দাম বেড়েছে ।
রাজধানীর খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে (মানভেদে) প্রতিকেজি ৫২ থেকে ৫৬ টাকায়। কোথাও আবার ভালো মানেরটা বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকা কেজি দরেও। এ ছাড়া মানভেদে পাইজাম প্রতিকেজি ৪৪ থেকে ৪৮, বিআর আটাশ প্রতিকেজি ৪৮ টাকা। গত মাসের প্রথম সপ্তাহে একই মিনিকেট চাল বিক্রি হয় প্রতিকেজি ৫০ থেকে ৫২ টাকা দরে। আর মাঝারি পাইজাম ৪২ থেকে ৪৬ টাকা ও বিআর আটাশ ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার চালের পাইকারি প্রতিষ্ঠান লকসাম ট্রেডার্সের ব্যবসায়ী মো. মোশাররফ হোসেন জানান, বাজারে ভালো মানের মিনিকেটের বস্তা (৫০ কেজি) এখন ২ হাজার ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা পর্যন্ত। ২ হাজার ৫৬০ টাকার নিচে মিনিকেটের বস্তা পাওয়া যাচ্ছে না। মে মাসের শুরুর দিকে যা ছিল ২ হাজার ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। অন্যদিকে পাইজামের বস্তা এখন ২ হাজার ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত এবং বিআর আটাশ চালের বস্তা ২ হাজার ২০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত।
চাল কিনতে আসা রায়েরবাগের জনতাবাগ এলাকার বাসিন্দা মো. আসলাম বলেন, করোনার মধ্যে ভ্যান চালিয়ে এমনিতেই ইনকাম নেই। বাজার করতে না পারলেও অন্তত ভাতের ব্যবস্থা হলে একভাবে দিন কাটানো যায়। কিন্তু চালের দাম যেভাবে বাড়তাছে, তাতে সামনের দিনগুলোয় আমাগো মতো গরীবগো না খাইয়া কাটাইতে হইবো।’
রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা টিসিবির প্রতিবেদনেও চালের দাম বেড়েছে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, সপ্তাহের ব্যবধানে নাজিরশাইল ও মিনিকেট চালের দাম কেজিতে সর্বোচ্চ চার টাকা বেড়েছে। টিসিবি বলছে, গতকাল রবিবার নাজির ও মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৫৫ থেকে ৬৮ টাকায়। গত সপ্তাহে যা ছিল ৫২ থেকে ৬২ টাকা। এ হিসাব অনুযায়ী দাম বেড়েছে ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ধানের দাম বেড়ে যাওয়াকেই দায়ী করছেন চালকল মালিকরা। তাদের দাবি, সরকার এবার বোরো মৌসুমে ধান সংগ্রহের জন্য দাম বেঁধে দেওয়ার পর ধানের বাজার চড়া হতে শুরু করে। যার প্রভাব ক্রমান্বয়ে চালের দামের ওপর পড়েছে।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক একেএম লায়েক আলী আমাদের সময়কে বলেন, কৃষকরা এখন ধান কম বিক্রি করছেন। ধানের দামও বাড়তি। তাই স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব পড়েছে চালের দামেও। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। তিনি আরও বলেন, আবহাওয়ার কারণেও সব চালকল সচল নেই। ঘূর্ণিঝড়, বৃষ্টিপাতের কারণে বেশিরভাগ চালকলের কাজের স্বাভাবিক ধারা ব্যাহত হচ্ছে। তার ওপর করোনা পরিস্থিতি। সব মিলিয়ে চাল সরবরাহে তারতম্য হচ্ছে। যার প্রভাব দামের ওপর পড়তে পারে।
পাইকার ও খুচরাপর্যায়ে দাম বেশি বাড়ানো হয় দাবি করে লায়েক আলী বলেন, সরকার প্রতিমণ ১ হাজার ৪০ টাকা ধানের দর বেঁধে দিয়েছে। সেই হিসাবে চালের দাম এখনো কমই আছে। তবে আমাদের এখানে দাম সামান্য বাড়লেও বাজারে গিয়ে বাড়ছে বেশি। পাইকার ব্যবসায়ীদের চালান পরীক্ষা করে দেখেন তারা আমাদের কাছ থেকে কত দামে চাল কেনেন এবং কত দামে বিক্রি করেন।
এদিকে গত ১৭ জুন এক ভিডিও কনফারেন্সে চালকল মালিকদের উদ্দেশে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, সরকারিভাবে সংগ্রহের জন্য চালের দাম বাড়ানো হবে না। চাল সরবরাহে গড়িমসি করা হলে প্রয়োজনে মিল মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্ত্রী বলেন, প্রতিবছর সমান লাভ হয় না। এবার করোনাকালীন মানুষকে সেবা করার উপযুক্ত সময়, সেবার মন-মানসিকতা নিয়ে আপনাদের এগিয়ে আসতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী বলেন, সরকার চাইলে চালকল মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। লাইসেন্স বাতিলও করতে পারে। কিন্তু চালকল মালিকরা তো আর এমনিতে দাম বাড়ানোর কথা বলছে না। ধানের দাম বেড়ে গেলে তো চালের দাম বাড়বেই। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই।
Leave a Reply